বাংলাদেশ, যার প্রকৃতি সবুজে ঘেরা এবং জীববৈচিত্র্যে সমৃদ্ধ, বিগত কয়েক দশকে ব্যাপক বন উজাড়ের শিকার হয়েছে। একসময় ঘন বনাঞ্চলে আবৃত এই দেশটি এখন দ্রুত নগরায়ন, শিল্প সম্প্রসারণ এবং অবৈধভাবে গাছ কাটার ফলে বিপুল পরিমাণে গাছপালা হারিয়েছে। পরিবেশবিদ ও গবেষকরা আশঙ্কা করছেন, এই ধারা চলতে থাকলে বাংলাদেশের অবশিষ্ট বনাঞ্চলও সংকটের মুখে পড়বে। যদিও ঠিক কোথায় বাংলাদেশের “শেষ বৃক্ষ” দাঁড়িয়ে থাকবে তা বলা কঠিন, তবে এই ধারণাটি বন সংরক্ষণের জরুরি প্রয়োজনকে প্রতীকীভাবে প্রকাশ করে।
বিপন্ন বনাঞ্চল ও তাদের সংকট
বাংলাদেশের সবচেয়ে হুমকির মুখে থাকা বনগুলোর মধ্যে অন্যতম হলো সুন্দরবন, যা বিশ্বের বৃহত্তম ম্যানগ্রোভ বন এবং রয়েল বেঙ্গল টাইগারের আবাসস্থল। যদিও এই অঞ্চল এখনও ঘন সবুজে আচ্ছাদিত, তবে জলবায়ু পরিবর্তন ও সমুদ্রপৃষ্ঠের উচ্চতা বৃদ্ধি এর অস্তিত্বের জন্য বড় হুমকি হয়ে দাঁড়িয়েছে। অন্যদিকে, পার্বত্য চট্টগ্রামের বনভূমিও দ্রুত সংকুচিত হচ্ছে। জুম চাষ, বসতি স্থাপন এবং বৃক্ষ নিধনের কারণে এই অঞ্চলের বনভূমির ঘনত্ব কমে যাচ্ছে। যদি এই ধারা অব্যাহত থাকে, তাহলে বাংলাদেশের শেষ গাছ শুধুমাত্র সংরক্ষিত জাতীয় উদ্যান বা বন্যপ্রাণী অভয়ারণ্যের মধ্যেই টিকে থাকবে।
মধুপুর বন, যা বাংলাদেশের প্রাচীনতম প্রাকৃতিক বনগুলোর মধ্যে একটি, ব্যাপক বন উজাড়ের শিকার হয়েছে। অবৈধ দখলদারিত্ব, বাণিজ্যিক চাষ এবং ভূমিদস্যুতার কারণে এ বন ক্রমশ সংকুচিত হচ্ছে। গারো ও কোচ আদিবাসী সম্প্রদায় যারা শত শত বছর ধরে এই বনভূমির সাথে সহাবস্থান করেছে, তাদের জীবনযাত্রা ও সংস্কৃতি এখন হুমকির মুখে। যদি বন উজাড়ের এই ধারা চলতে থাকে, তাহলে একদিন হয়তো মধুপুরের শেষ গাছ একটি পরিত্যক্ত কোণে নিঃসঙ্গভাবে দাঁড়িয়ে থাকবে।
বন ধ্বংসের অন্যান্য কারণ ও তার প্রভাব
শুধু শহরায়ন বা কৃষি সম্প্রসারণই নয়, উপকূলীয় অঞ্চলে চিংড়ি চাষের ব্যাপক বিস্তারও বন ধ্বংসের একটি প্রধান কারণ। ম্যানগ্রোভ বন কেটে বাণিজ্যিক মাছ ও চিংড়ি খামার তৈরির ফলে উপকূলীয় পরিবেশ মারাত্মকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে। এটি শুধুমাত্র গাছপালা ধ্বংস করে না, বরং উপকূলীয় বাস্তুতন্ত্রের ভারসাম্যও নষ্ট করে।
অন্যদিকে, কাঠ, কাগজ ও আসবাবপত্র শিল্পের কাঁচামালের জন্য নির্বিচারে বৃক্ষ নিধন পরিবেশের জন্য বড় হুমকি হয়ে দাঁড়িয়েছে। শহর ও গ্রামে জ্বালানি কাঠের ব্যবহারও বন উজাড়ের অন্যতম কারণ। যদি এই অবস্থা চলতে থাকে, তাহলে বাংলাদেশের শেষ বৃক্ষ একদিন দুষ্প্রাপ্য হয়ে উঠবে, এবং একটি বিপন্ন প্রকৃতির প্রতীক হিসেবে দাঁড়িয়ে থাকবে।
সংরক্ষণের উদ্যোগ ও করণীয়
তবে সবকিছুই অন্ধকার নয়। সরকার এবং বিভিন্ন পরিবেশ সংস্থা বন সংরক্ষণের জন্য বিভিন্ন উদ্যোগ নিয়েছে। বৃক্ষরোপণ অভিযান, পুনঃবনায়ন প্রকল্প এবং সংরক্ষিত বনাঞ্চলের সম্প্রসারণের মাধ্যমে কিছুটা হলেও ইতিবাচক পরিবর্তন আনা সম্ভব হচ্ছে। লাউয়াছড়া জাতীয় উদ্যান ও রেমা-কালেঙ্গা বন্যপ্রাণী অভয়ারণ্যের মতো সংরক্ষিত এলাকাগুলোতে এখনো কিছু মূল্যবান গাছ সংরক্ষিত রয়েছে, যা ভবিষ্যতের জন্য আশা জাগায়।
তবে, শুধু গাছ লাগানোই যথেষ্ট নয়, কঠোর পরিবেশ আইন বাস্তবায়ন, জনসচেতনতা বৃদ্ধি এবং বন দখল ও অবৈধ বৃক্ষ নিধনের বিরুদ্ধে কার্যকর ব্যবস্থা নেওয়া অত্যন্ত জরুরি। স্থানীয় জনগণ, বিশেষ করে আদিবাসী সম্প্রদায়ের ভূমিকা আরও শক্তিশালী করতে হবে, কারণ তারা বন সংরক্ষণে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখতে পারে।
শেষ বৃক্ষ: প্রতীক নাকি বাস্তবতা?
যদি একদিন সত্যিই বাংলাদেশের “শেষ বৃক্ষ” রয়ে যায়, তবে সেটি হয়তো কোনো দুর্গম সংরক্ষিত অঞ্চলে দাঁড়িয়ে থাকবে—সুন্দরবনের গভীর বনাঞ্চলে বা পার্বত্য চট্টগ্রামের কোনো গোপন কোণে। তবে এই চিন্তাটি কেবল কল্পনা হিসেবে নয়, আমাদের জন্য একটি সতর্ক সংকেত হওয়া উচিত। বন ধ্বংসের বর্তমান গতি বজায় থাকলে, একসময় হয়তো সত্যিই এমন একটি পরিস্থিতি আসবে, যেখানে বাংলাদেশের বনাঞ্চল বিচ্ছিন্ন ছোট ছোট দ্বীপের মতো টিকে থাকবে, যা কোনো প্রাণবৈচিত্র্যকে টিকিয়ে রাখতে পারবে না।
গাছ আমাদের শুধু অক্সিজেন ও কাঠই দেয় না, বরং জীববৈচিত্র্য সংরক্ষণ, জলবায়ু নিয়ন্ত্রণ এবং প্রাকৃতিক দুর্যোগ প্রতিরোধেও গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। বাংলাদেশের শেষ গাছের বিলুপ্তি মানে শুধু একটি গাছের হারিয়ে যাওয়া নয়; এটি হবে অসংখ্য প্রজাতির বিলুপ্তি, মানুষের জীবিকা হুমকির মুখে পড়া এবং দেশের প্রকৃতি ও ইতিহাসের একটি বিশাল অংশের ক্ষতি।
বর্তমানে হয়তো বাংলাদেশের নির্দিষ্ট কোনো “শেষ বৃক্ষ” নেই, তবে আমরা একটি ভয়াবহ বনহীন ভবিষ্যতের দিকে এগিয়ে যাচ্ছি। টেকসই বন সংরক্ষণ নীতি, ব্যাপক পুনঃবনায়ন এবং কঠোর পরিবেশ সুরক্ষা ব্যবস্থা গ্রহণ করা না হলে, সেই দিন খুব দূরে নয় যখন শেষ গাছের অস্তিত্ব বাস্তবতায় পরিণত হবে। তাই, এই দেশ ও পৃথিবীর প্রতিটি নাগরিকের দায়িত্ব হলো বন সংরক্ষণে সক্রিয় ভূমিকা রাখা, যাতে আমাদের ভবিষ্যৎ প্রজন্মকে এই প্রশ্ন করতে না হয়—বাংলাদেশের শেষ বৃক্ষ কোথায়?